সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১০ অপরাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
মানুষকে উন্নত জীবন ও সুচরিত্র গঠনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ঘটেছিল। তিনি মানবজীবনের ব্যবহারিক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশেষ করে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক আচার-আচরণ, কর্মজীবন ও আর্থিক অবস্থান সম্পর্কে সাহাবিদের হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। মহানবী (সা.)-এর শেখানো বিষয়সমূহের অন্যতম কয়েকটি হলো
নিয়তের একনিষ্ঠতা : ব্যক্তিজীবনে নিয়তের একনিষ্ঠতা বজায় রাখা। নিয়তের বিষয়টি অন্য কেউ না বুঝলেও আল্লাহতায়ালা বোঝেন। সুতরাং কথা ও কাজে অন্য মানুষকে কষ্ট না দেওয়া, জবানের হেফাজত করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী ও দুই পায়ের মধ্যবর্তী স্থানের নিরাপত্তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব।’
ভারসাম্যপূর্ণ জীবন : ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন করা ইসলামের শিক্ষা। প্রতিটি কাজের হক ঠিকমতো পালন করাই হলো ভারসাম্য। মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘এভাবেই আমি তোমাদের এক মধ্যমপন্থি মানব দলে পরিণত করেছি, যেন তোমরা দুনিয়ার অন্যান্য মানুষের ওপর (হেদায়েতের) সাক্ষী হয়ে থাকতে পারো (এবং একইভাবে) রাসুল (সা.) তোমাদের সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে।’ ইসলাম কৃপণতাকে সমর্থন করে না আবার অপচয়কেও সমর্থন করে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের নির্দেশনা দেয়।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) বলেছেন, দায়িত্বশীলদের জন্য চারটি গুণ অপরিহার্য। ক. কোমলতা, তবে দুর্বলতা নয়। খ. দৃঢ়তা, তবে কঠোরতা নয়। গ. স্বল্প ব্যয়িতা, তবে কৃপণতা নয়। ঘ. দানশীলতা, তবে অপব্যয় নয়। হজরত লোকমান (আ.) তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, নিজের চাল-চলনে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো।
পিতা-মাতাকে কষ্ট না দেওয়া : পারিবারিক জীবনে পিতা-মাতাকে কোনো কষ্ট না দেওয়ার ব্যাপারে সদা সজাগ থাকা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহান আল্লাহ সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘তোমার মালিক আদেশ করেছেন, তোমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারও ইবাদত করো না এবং তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তাহলে তাদের সঙ্গে বিরক্তিসূচক কিছু বলো না এবং কখনো তাদের ধমক দিয়ো না তাদের সঙ্গে সম্মানজনক ভদ্রজনিত কথা বলো।’
বান্দার হকের প্রথম হলো মা-বাবার হক। মায়ের দিকে একবার নেক নজরে তাকালে কবুল হজের সওয়াব পাওয়া যায়। নিয়মিত মা-বাবাকে সালাম দেওয়ার অভ্যাস আমাদের সবার মধ্যে থাকা প্রয়োজন। যারা পিতা-মাতার কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেন তাদের প্রতিদিন অন্তত একবার ফোন করে খোঁজ নেওয়া দরকার। বাড়িতে গেলে পিতা-মাতার সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া এবং যাওয়ার সময় সাধ্যানুযায়ী পিতা-মাতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিধেয় সামগ্রী ও ব্যবহার্য বস্তু নিয়ে যাওয়া। বাড়ির বাইরে থাকলে নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেওয়া। পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। ছোট ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’
বড়রা খারাপ আচরণ করলেও তাদের সঙ্গে বেয়াদবি করা যাবে না। পরিবারের সদস্যদের কাছে সত্যপন্থি ও সত্যনিষ্ঠ থাকতে হবে। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ প্রত্যেকের হক আদায় করতে হবে। পরিবারের সবার সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করা। কোনো সন্তান কিংবা ভাইয়ের প্রতি বেশি ঝুঁকে না পড়া। মুসলিম ফারায়েজের বিধানের আলোকে ভাই-বোনদের হক সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।
সামাজিক আচরণ : আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক বজায় রাখা। জানাজা, বিয়ে-শাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করা। রোগীর সেবা, অফিস-আদালতে কাজে সহযোগিতা করা, ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে গ্রামবাসীর সহযোগিতা নিয়ে চেষ্টা করা। অন্য মানুষের কল্যাণ কামনা করা। দ্বীন মানেই হচ্ছে কল্যাণ কামনা করা। পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের সম্পর্ক বজায় রাখা। ঝগড়া না করা, সম্ভব হলে বিরোধ মেটানোর ব্যবস্থা করা। আল্লাহতায়ালা সুরা হুজুরাতের ১০ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘মুমিনরা তো একে অপরের ভাই অতএব (বিরোধ দেখা দিলে) তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করা হবে।’ পরস্পরের দোষ খুঁজে না বেড়ানো। আল্লাহতায়ালা সুরা হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে বিদ্রƒপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না।’
কর্মজীবন : নিজ কর্মজীবনের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। অধস্তনদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। যথাসময়ে কর্মস্থলে যাওয়া। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।
ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, স্বজনপ্রীতি না করা। সহকর্মীদের ছিদ্রান্বেষণ কিংবা তাদের পেছনে পড়ে না থাকা। যোগ্যতার অহংবোধ পরিহার করে চলা।
আর্থিক জীবন : সৎপথে উপার্জন করা। আয়ের ক্ষেত্রে অনৈতিক পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ না করা। আয় অনুপাতে ব্যয় করা, লেনদেনে ওয়াদা রক্ষা। অর্থ উপার্জনে মধ্যমপন্থা অবলম্বন। উচ্চাকাক্সক্ষা না থাকা, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া। নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী, গ্রামবাসীর মধ্যে গরিব লোকদের মধ্যে সাধ্যানুসারে দান করা। অতিদ্রুত বড়লোক হওয়ার আকাক্সক্ষা না করা। সাহেবে নেসাব হলে জাকাত-ওশর আদায় করতে অভ্যস্ত হওয়া। কৃপণতা পরিহার করা। ঋণমুক্ত থাকা।
এক কথায় সামগ্রিক বিষয়ে প্রশ্নবোধক মুক্ত চরিত্র গঠন করা। দয়াময় আল্লাহর দরবারে জবাবদিহির মানসিকতা সহকারে দুনিয়ায় চলা, অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। ব্যবহারিক জীবন উন্নত করার লক্ষ্যে রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের ব্যবহারিক জীবনকে সামনে রাখা। সর্বাবস্থায় খারাপ ব্যবহারের জবাব উত্তম কথার দ্বারা দেওয়া। মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে অন্তর দ্বারা বোঝার চেষ্টা করা। এভাবেই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পরিচালনা করা।
ভয়েস/আআ